Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

নাজমা আনোয়ারের অভিনয়ে সৃজন-স্বাতন্ত্র্য : উইংসের আড়াল থেকে

Written by আব্দুল্লাহেল মাহমুদ.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

মঞ্চে চলছে নাট্যাভিনয়। অন্ধকার মঞ্চে গভীর মনোযোগ দিয়ে অভিনয় দেখছেন দর্শকবৃন্দ। মাঝে মাঝেই শোনা যাচ্ছে নানারকম অনুভূতির শব্দ। কখনো মৃদু, কখনো উচ্চশব্দে। কখনো-বা উচ্চহাসি আর হাততালিতে মুখরিত হয়ে উঠছে অন্ধকার-মঞ্চ। একসময় নাটক শেষ হয়। দর্শক বেরিয়ে যান গ্যালারি থেকে, যুক্ত হন দৈনন্দিন কাজে। এক-দুইঘণ্টার অভিনয়কাণ্ডের পর নাটক কোথায় যায়?

নাটক চলে যায় দর্শকের স্মৃতিতে, মগজের ভিতর। তারপর সময়ের সাথে সাথে টাটকা স্মৃতি থেকে তা ক্রমশ ফ্যাকাশে হালকা স্মৃতিতে পরিণত হয়। একসময় হয়ত তা স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায় চিরদিনের জন্য।

এরকম কোনো বিষয়ে কিছু লেখা তাই সত্যিই একটি দুরূহ-কাজ। আর তা যদি হয় তিন-চার দশকের আগের ঘটনা, তাহলে তা কতটা কঠিন তা বলাই বাহুল্য। আর সে কারণেই হয়ত একটি কথা প্রচলিত- ‘দেহপটসনে নট সকলই হারায়’। কথাটি বেদনাদায়ক হলেও সত্যি।

এমন একটি বিষয় নিয়ে প্রিয়ভাজন সম্পাদক কয়েকজন অভিনেতা-অভিনেত্রীর অভিনয়ের উপর একটি মূল্যায়নধর্মী লেখার জন্য বারবার তাগাদা দিচ্ছিলেন। তার নির্দিষ্ট করে ছোটো তালিকাটি ছিল এরকম- ১. মোহাম্মদ জাকারিয়া, ২. নাজমা আনোয়ার, ৩. হুমায়ূন ফরীদি এবং  ৪. খালেদ খান।

এদের সকলের অভিনয়ই দেখেছি। সবার সাথে ছিল ঘনিষ্ঠ সর্ম্পকও। তবুও সবার সম্পর্কে লেখার সাহস করতে পারি নি। কারণ একটিই, তা হলো যদি অমূল্যায়ন করে ফেলি। তাই শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিই, নাজমা আনোয়ারকে নিয়ে লিখতে। এর অন্যতম কারণ হলো, একই দলে কাজ করেছি একসাথে। এ লেখাটি কোনোভাবেই নাজমা আনোয়ারের অভিনয়শৈলীর পরিপূর্ণ মূল্যায়ন নয়। বলা যেতে পারে- স্মৃতিচারণা।

নাজমা আনোয়ার ‘আরণ্যক নাট্যদল’-এ যোগ দেন ১৯৮১ সালে ইবলিশ নাটকের অভিনয় দিয়ে। যদিও তার মঞ্চে আগমন আরও আগে ‘ড্রামা সার্কেল’ প্রযোজিত দান্তের মৃত্যু দিয়ে। তার সেসময়ের অভিনয়-সম্পর্কে তেমন কিছুই জানিনে। গত শতকের আশির দশকের ইবলিশ নাটকে তাকে আমি পেয়েছি একজন পরিপূর্ণ অভিনেত্রী হিসেবে। আমি তখন মঞ্চে নেপথ্যের কর্মী। ছোটো ছোটো আসা-যাওয়ার অভিনেতা। বলাবাহুল্য, অভিনেতা হওয়ার আকাঙ্ক্ষ আমার কোনোকালেই ছিল না। আরণ্যকে যোগ দিয়েছিলাম নাটক লেখার সুপ্তবাসনা নিয়ে। মঞ্চে উপস্থিত হয়ে সংলাপ বলার চাইতে উইংসের আড়াল থেকে অন্যদের অভিনয় দেখাটাই বেশি টানত আমাকে।

ইবলিশ নাটকে নাজমা আনোয়ার অভিনীত ‘আতসী’ চরিত্রে অভিনয়কর্মটি আমার দেখা এ যাবৎকালের সেরা অভিনয়ের একটি। আতসীর চরিত্রে অভিনয়কে আমার অভিনয় মনে হয় নি। মনে হতো সত্যিকার আতশীকেই দেখছি। গ্রামীণপটভূমিতে একজন নিম্নবর্গীয় অসহায় সংগ্রামী নারী ‘আতসী’। চারদশক আগে মঞ্চের সেই আতসীকে আমি এখনও দেখতে পাই। অসংখ্য স্মৃতির ভীড়ে আতসী যে পদক্ষেপে মঞ্চে প্রবেশ করতেন, তা ওইরকম জীবনযাপন করা মহিলার পক্ষেই সম্ভব। নিজের ‘নাজমা আনোয়ার’ পরিচয় মুছে ফেলে ‘আতসী’তে রূপান্তরিত হওয়া কেমন করে সম্ভব হতো তা সত্যিই বিস্ময়কর! উইংসের আড়াল থেকে একটি বিষয় প্রায় প্রতিটি প্রদর্শনীতে লক্ষ করেছি, তাহলো, কখন মঞ্চে প্রবেশ করবেন তার জন্য গভীর প্রতীক্ষা। প্রতিটি মুহূর্তে সে কী তীব্র উৎকণ্ঠা, যা আমি খুব কম অভিনেতা-অভিনেত্রীর মাঝে দেখেছি।

ইবলিশ নাটকে আমার ছোটো একটি চরিত্র ছিল- পালকি বেহারার। বলাবাহুল্য, সেখানে কোনো সংলাপ ছিল না। পরবর্তীকালে বিকল্পচরিত্র হিসেবে আতসীর পিতার চরিত্র যখন পেলাম, তখন মঞ্চের পাশে রীতিমতো ঘামছি। তখন হঠাৎ পিঠে কারো হাতের স্পর্শ পেলাম। পিছনে তাকিয়ে দেখি নাজমা ভাবী। তারপর তার অভয়বাণী- ‘ঘাবরাইস না, আমি আছি’। নিমিষেই সব উৎকণ্ঠা উধাও।

তার অভিনয়ের সবচেয়ে বড় দিকটি হলো স্বতঃস্ফূর্ততা। অভিনয় করছেন তা মনে হতো না। ইবলিশ নাটকে তার অভিনয়ের অন্যতম মুহূর্ত হলো নাটকের শেষদৃশ্যে। স্বামী-পরিত্যাক্তা আধাপাগল আতসীর প্রতিরোধের নাট্যমুহূর্তটি। দৃশ্যটির কথা মনে করলে আজও রোমহর্ষ হয়। মনে হতো এরকম গ্রামীণ চরিত্রের জন্যই শুধু নাজমা আনোয়ার। কিন্তু ভুল ভাঙল গিনিপিগ নাটকের সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের অভিনয় দেখে।

গিনিপিগ মামুন ভাইয়ের (মামুনুর রশীদ) একটি ভিন্ন-ধারার নাটক। সমাজের উচ্চস্তরের চরিত্র নিয়ে নাটক। ঘটনাপ্রবাহে এসেছে জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক রাজনীতি-অর্থনীতি। এ নাটকে নাজমা আনোয়ার অভিনয় করেছেন আতসীর সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রে। এই চরিত্রে তার অভিনয় দেখে মনে হয়েছে তিনি বুঝি গুলশান-বনানীর বিলাসী-জীবনের বাসিন্দা। তার কণ্ঠে সুললিত সুরে রবীন্দ্রসংগীত। এ প্রসঙ্গে একটি ছোট্ট স্মৃতি পাঠকের সাথে ভাগাভাগি করে নেয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। নাটকটিতে ‘ডালবাহাদুর’ নামে একটি ক্লাউনের চরিত্রে অভিনয় করতাম। অভিনয় শেষ হলে স্বভাবসুলভ উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে যেতাম অন্যদের অভিনয় দেখার জন্য। নাটকের একটি দৃশ্যে নাজমা আনোয়ারের গান গাওয়ার ছোট্ট অংশ ছিল। তিনি গাইছিলেন একটি রবীন্দ্রসংগীত:

জড়ায়ে আছে বাধা ছাড়ায়ে যেতে চাই
ছাড়াতে গেলে ব্যথা বাজে
মুক্তি চাহিবারে তোমার কাছে যাই
চাহিতে গেলে মরি লাজে।

প্রতিটি প্রদর্শনীতে উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে তার সাথে গুনগুন করে গাইতাম। একদিন ঘটল তার ব্যতিক্রম। গুনগুন পরিণত হলো উচ্চস্বরে। পাশে দাঁড়িয়ে অন্য এক সহঅভিনেতার হস্তক্ষেপে চুপ করতে বাধ্য হলাম। উচ্চবিত্ত কিংবা বিত্তহীন চরিত্রের বাইরে মধ্যবিত্ত চরিত্রেও তার সাবলীল অভিনয় পুরানোদিনের দর্শক হয়ত এখনও স্মরণ করতে পারবেন। সেরকম একটি চরিত্র সমতট নাটকে ‘মা’ ও ‘স্ত্রী’র চরিত্রটি। স্বাধীনতাযুদ্ধের পটভূমিতে মামুন ভাইয়ের রচিত এ নাটকে তার অভিনয় পরিমিতিবোধের এক আশ্চর্য সমীকরণ। উদ্বেগ, উত্তেজনার পাশে কর্তব্যবোধের এক অপূর্ব মিশ্রণ।

তার অভিনয়ের এটিই বিশিষ্ট দিক, তা হলো, যেকোনো চরিত্রে খুব সহজেই নিজেকে মানিয়ে নেয়া।

আমার লেখা নানকার পালা নাটকে ‘মতির মা’ চরিত্রে তার অভিনয় দীর্ঘ চার দশক পরেও আমার স্মৃতিকে নাড়া দিয়ে যায়। জমিদারের নির্যাতনে পুত্রের মৃত্যুতে শোকাহত মায়ের যে আর্তি, বেদনা, ক্ষোভ তা ঐরকম শিকার মা ছাড়া আর কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। মতির মৃত্যুর পর তার কণ্ঠে যখন উচ্চারিত হয়- আমার মানিকরে যারা কাইড়া নিছে, খোদার গজব পড়ুক তাগোর বুকে, তাগোর বংশ নির্বংশ হউক, তুই বিচার করিস খোদা- তখন সমস্ত হল স্তব্ধ হয়ে যেত এক সংক্রমিত শোকের আবহে।

নাটকের এক পর্যায়ে যখন নানকারবৃন্দ জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাদের করণীয় নিয়ে দোলাচলে, তখন তার কণ্ঠে ধ্বণিত হলো এক অমোঘ বাণী, প্রতিরোধের বার্তা- আমরার সামনে অহন একটাই পথ, জীবন তো একটাই, একবার গেলে ফিরবার উপায় নাই- মরণের আগে তাই কইয়া যাইবার চাই-
লিলুয়া বাতাসে যেমুন গাঙে ওঠে ঢেউ
তেমনি থির থির কইরা কাঁপে আমরার পরাণ
এইবার মরাগাঙে উঠুক ঢেউ- য্যান সাগর সমান।

সেই অতিলৌকিক মুহূর্তে মঞ্চ যেন গা-নাড়া দিয়ে উঠত। এরকম মুহূর্তই একজন অভিনেতা-অভিনেত্রীর পারম পাওয়া, শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।

হঠাৎ করেই চলে গেলেন তিনি। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ করেই চলে গেলেন। অবশ্য এর কিছু আগে থেকেই কেমন যেন নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলেন। কোন অভিমানে তা জানতে পারি নি। একজন ভালো অভিনয়শিল্পীকে অত্যন্ত সংবেদনশীল মানুষ হতে হয়। নাজমা আনোয়ার ছিলেন তাই।

আমরা যারা তার কাছাকাছি ছিলাম, তখন তার যে মাতৃসুলভ স্নেহ ভালোবাসা পেয়েছি, তা কখনো ভুলবার নয়। মঞ্চ থেকে দর্শকের ভালোবাসা ছাড়া কিছুই পান নি তিনি। আমরাও দিতে পারি নি- এ আমাদের দীনতা।

তিন-চার দশক আগের সেই মঞ্চাভিনয়গুলি ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তবে তার অভিনীত কিছু টিভি নাটক আর চলচ্চিত্রে তার প্রতিভার স্বাক্ষর এখনও পাওয়া যায়। তার অভিনীত শঙ্খনীল কারাগার, দুখাই, জয়যাত্রা, শঙ্খনাদ, হাজার বছর ধরে ইত্যাদি চলচ্চিত্র আর টেলিভিশনে সময় অসময়, সুপ্রভাত ঢাকা, সাতজন যাত্রী, করিমন বেওয়া, হারাণের নাতজামাই, জননী জন্মভূমি, কোথাও কেউ নেই, প্রিয় পদরেখা-সহ আরও বেশ কিছু নাটকে তার অভিনয় দেখে এ সময়ের যেকোনো দর্শক সহজেই অনুমান করতে পারবেন তিনি কত বড়ো অভিনেত্রী।

তথ্যপ্রযুক্তির এই ঊর্বর সময়ে উৎসাহী যে কেউ তা দেখে নিতে পারেন।

একটি বিষয় অস্বীকার করবার কোনো উপায় নেই, তা হলো তাকে আমরা যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারি নি। দিতে পারি নি তার প্রাপ্য সম্মান।

আব্দুল্লাহেল মাহমুদ ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): নাট্যকার