Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

বহরমপুরের নাট্য ইতিহাস ও বর্তমান

Written by মোহিত বন্ধু অধিকারী.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

বহরমপুরের নাট্য ইতিহাসের বৃত্ত কখনোই পূরণ হবে না, যদি না মুর্শিদাবাদের শতাব্দী প্রাচীন নাট্য ইতিহাসের উপর আলোর ফোকাসটা না ফেলা যায়। মুর্শিদাবাদ বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা। এটি বাংলায় শুধু নয়, ভারতবর্ষের দরিদ্রতম জেলাগুলোর মধ্যে একটি। সাক্ষরতা ও শিক্ষায় অনেক পেছনের সারিতে। এই পিছিয়ে পড়া জেলার নাট্য ইতিহাস প্রায় দুইশত বছরের পুরনো। অবাক হওয়ার উপাদান বৈকি। গবেষণার বিষয় হিসেবেও দারুণ আকর্ষণীয়।

কলকাতায় যখন একটি-দুটি নাট্যশালা গড়ে উঠেছে- সেই সময় এই বহরমপুরে গড়ে উঠেছে ইংরেজ সেনানিবাস- ‘বহরমপুর ক্যান্টনমেন্ট’। তৎকালীন ব্রিটিশ সমাজে নাটকের আঁতুড়ঘর- ‘সেনানিবাস’ কিনা জানা নেই, কিন্তু ইতিহাসগতভাবে জানা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে কলকাতার উপকণ্ঠে সেনাবাহিনীর ছাউনি ক্যান্টনমেন্টের কাছে গড়ে উঠেছে ‘দমদম থিয়েটার’ (১৮১৭), আবার ঐ একই সময়ে বহরমপুর শহরে সেনাদের জন্য নির্মিত ক্যান্টনমেন্ট অঞ্চলে ম্যাগাজিন বিল্ডিং-এ (১৮২০) গড়ে উঠেছে একটি অস্থায়ী নাট্যমঞ্চ। স্বাভাবিকভাবেই সেনাবাহিনীর মনোরঞ্জন ও বিনোদনের জন্যই এই মঞ্চ গড়ে তোলা হয়। এখানে টিকেটের বিনিময়ে থিয়েটার দেখার সুযোগ ছিলো। যতদূর জানা যায়, সে-যুগের প্রখ্যাত অভিনেত্রী ‘এসথার লিজ’ এই মঞ্চের নাট্যভিনয়ে অংশগ্রহণ করেছেন। অনুমান করতে অসুবিধা হয় না যে, ইনিই সেই ‘অভিনেত্রী এসথার লিজ’- যিনি একসময়ে ‘দমদম থিয়েটার’-এর হাল ধরেছিলেন। পরবর্তীকালে যার উৎসাহে কলকাতায় নির্মিত হয়েছিলো ‘সাঁ-সুসি’ থিয়েটার এবং যিনি এই মঞ্চে ১৮৪৩ সালে ‘দ্য হ্যান্ডারসাম হাজব্যান্ড’ নাটকে অভিনয়কালে প্রদীপের আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিলেন।

কলকাতায় ১৮৫৭-তে যখন মঞ্চস্থ হলো সামাজিক সমস্যাভিত্তিক প্রথম বাংলা নাটক ‘কুলীনকুল সর্বস্ব’, তখন মধুসূদনের নাটক বাংলা মঞ্চে আসতে শুরু করলো। যখন ‘নীলদর্পণ’ মঞ্চস্থ হলো (১৮৭২) ন্যাশনাল থিয়েটারের ব্যানারে, তখন বহরমপুর শহর ক্রমেই বেড়ে উঠছে শহর হিসেবে। এই জেলায় ১৮৫৯ সাল নাগাদ কান্দি রাজবাড়িতে একটি বিরাট রঙ্গমঞ্চ গড়ে ওঠে। ওই নাট্যমঞ্চের উদ্বোধক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পরামর্শেই একটিমাত্র প্রযোজনা মঞ্চস্থ করার পর সেটি কান্দি রাজস্কুলের হলঘরে পরিণত হয়। ১৮৯০-৯৫ সময়কালে কান্দি মহকুমার জজান-এ গড়ে উঠেছিলো একটি নাট্যদল ‘ড্রামাটিক ক্লাব’। বহরমপুরের রাজপরিবারে সেই আগ্রহের নিদর্শন আমরা দেখতে পাচ্ছি ঊনবিংশ শতাব্দীর আটের দশকে, যখন কাশিমবাজারে মহারাণী স্বর্ণময়ী কলকাতার দলকে নিয়ে এসে নাট্যমোদীদের ‘নাটক’ দেখার সুযোগ করে দিতেন। স্বর্ণময়ীর মৃত্যুর পর যখন রাজা কৃষ্ণনাথের ভাগ্নেয় মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী কাশিমবাজারের সম্পত্তির অধিকারী হলেন- তারপরই যেনো নাট্যচর্চা বিশেষভাবে গতিপ্রাপ্ত হতে থাকলো। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগের একটি ঘটনা মুর্শিদাবাদের নাট্যচর্চার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, কেননা, শুধু বাংলা নয়, সারা ভারতবর্ষের নাট্যচর্চার ইতিহাসে তা এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিলো। ১৮৯৯ সালে মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর প্রত্যক্ষ উদ্যোগে ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম নাট্যশিক্ষা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলো কাশিমবাজারে- ‘দি কাশিমবাজার স্কুল অব ড্রামা’। সেই বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়ে আসা হয়েছিলো গিরিশবাবুর স্নেহধন্য প্রখ্যাত অভিনেতা গোবর্দ্ধন বন্দ্যোপাধ্যায়কে। এই সঙ্গে রাধিকামোহন গোস্বামীকে অধ্যক্ষ করে একটি গানের স্কুলও প্রতিষ্ঠিত হয়। নাট্যবিদ্যালয়ে থিয়েটারের প্রয়োজনীয় সব কলার জন্যই শিক্ষাদানের ব্যবস্থা ছিলো। দৃশ্যপট নির্মাণ, কপিকলের ব্যবহার, মঞ্চমায়ার সৃষ্টি, কাঠের কাজ, আলো ও মেক-আপের কাজ ইত্যাদি সব বিষয়েই অধ্যয়ন করতো ছাত্ররা। এই নাট্যবিদ্যালয়টি প্রায় পঁচিশ বছর তার কর্মকাণ্ড বজায় রেখেছিলো।

অন্যদিকে ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষভাগে ১৮৯৭-৯৮ নিমতিতার ( সুতী থানা) জমিদার মণীন্দ্রনারায়ণ ‘নিমতিতা হিন্দু থিয়েটার’ নামে নাটকের দল প্রতিষ্ঠ করেন। তৈরি করেন নাট্যমঞ্চও। সেই সময়েই তিনি সেখানে ভোল্টের জেনারেটর ব্যবহার করেছিলেন কিন্তু মঞ্চে শব্দ হয় বলে মঞ্চের আলো নিয়ন্ত্রিত হতো স্টোরেজ ব্যাটারি দিয়ে। এবং তার জন্য তৈরি করেছিলেন একটা ব্যাটারিঘর। শোনা যায় মণীন্দ্রনারায়ণ তাঁর অভিনেতাদের সংসার ভরণ-পোষণের ব্যয়ও বহন করতেন। তবে তিনি এর জন্য প্রজাদের কাছ থেকে বাড়তি কর ‘সেস’ হিসেবে আদায় করতেন।

নিমতিতা মঞ্চের প্রথম নাটক ‘নল-দয়ময়ন্তী’। পরবর্তী সময়ে ‘শঙ্করাচার্য’, ‘বিল্বমঙ্গল’, ‘চৈতন্যলীলা’. ‘প্রতাপাদিত্য’, ‘সাজাহান’, ‘নর-নারায়ণ’, ‘ভীষ্ম’, ‘আলীবাবা’ প্রভৃতি প্রযোজনা মঞ্চস্থ হয়েছে। ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ তাঁর বহু নাটক এই রাজবাড়িতে বসেই লিখেছেন। ‘নর-নারায়ণ’ লেখা হয় এই মঞ্চের জন্যই। ‘ভীষ্ম’ নাটকের দ্বিতীয় সংষ্করণের ৮৯ পৃষ্ঠায় পাদটিকাতে পরিষ্কার উল্লেখ রয়েছে- মুর্শিদাবাদ নিমতিতা হিন্দু থিয়েটারের জন্য এই অংশ লিখিত ও থিয়েটারে প্রথম অভিনীত হয়।

বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এই জেলার মহকুমাগুলোতে কিছু কিছু অঞ্চলের নাট্য সংবাদ পাওয়া যায়। কান্দি মহকুমার জেমো রাজবাড়িতে ‘রাজেন্দ্র নাট্য মন্দিরে’র অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ১৯৪৩ সাল থেকে বর্তমান সময়ের মধ্যে ‘জয়হিন্দ পাঠাগার’, ‘বাণী সংঘ’, ‘সর্বোদয়’, ‘আহদী গোষ্ঠী’, ‘ক্রান্তি শিল্পী সংস্থা’, ‘কোরাস’ ইত্যাদি সংগঠনের নামও পাওয়া যায়। ১৯৭৮ সালে জন্ম ‘ঝড়’ নাট্যগোষ্ঠীর। সম্ভ্রান্ত অঞ্চল পাঁচথুপিতে ১৯৭৬ সালে জন্ম ‘উদয়ন’-এর।

জঙ্গীপুর মহকুমার ধুলিয়ানে ১৯৪০ সালে নির্মিত হয় ‘স্ত্রীভবন’ নামে একটি মঞ্চ। তুলনামূলকভাবে নতুন শহর রঘুনাথগঞ্জের নাট্যচর্চার ইতিহাস বিশেষ উল্লেখযোগ্য নয়। বালিঘাটা অঞ্চলের জমিদারবাবুর পৃষ্ঠপোষকতায় বহু নাটক অভিনীত হয়েছে এখানে। ১৯১৩-১৪ সালে অভিনীত হয়েছিলো তৎকালীন সদ্য প্রকাশিত দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটক। তিরিশের দশকে ‘গোপাল নাট্যমন্দির’, ‘দেশবন্ধু পাঠাগার’ প্রমুখ নাট্যদল বেশ কিছু প্রযোজনা উপহার দিয়েছে। উল্লেখ্য, প্রখ্যাত নাট্যকার মোহিত চট্টোপাধ্যায় ৬০-এর দশকে অধ্যাপক হিসেবে এখানে আসেন। এখানে এসেই তিনি ‘সরাইখানায় একরাত্রি’ (A night at an inn) অনুবাদ করেন। এই নাটকও এখানে অভিনীত হয়েছে। কিন্তু ধারাবাহিকভাবে নাট্যচর্চা করে গেছে এমন নাট্যদলের কথা বিশেষ জানা যায় না। বর্তমানে অবশ্য তরুণ চৌবের নেতৃত্বে ‘নাট্যম বলাকা’ প্রতিনিয়ত থিয়েটারের কাজে নিযুক্ত আছে, এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি ‘রবীন্দ্রভবন’। তৈরি হয়েছে নাট্যদর্শক। ‘নাট্যম বলাকা’ প্রতিবছর আমন্ত্রিত দল নিয়ে নাট্যোৎসবেরও আয়োজন করে আসছিলো। মহকুমার শহর লালবাগে নাট্যচর্চার প্রাবল্য কখনোই দেখা যায়নি। যদিও জমিদার ধরণী ঘোষের বাড়িতে নাট্যচর্চা চলতো। সে ১৯৩৮ এর কথা। তারও আগে ১৯২৩-২৭ সাল নাগাদ বান্ধব সমিতির উদ্যোগে প্রযোজিত হয়েছে ‘হিন্দুবীর’ নাটক। ১৯৫৬-৫৭ সালে আবার তাঁরা সক্রিয় হন, প্রযোজিত হয় ‘সীতারাম’, ‘কর্ণার্জুন’ প্রভৃতি নাটক। ১৯৫৯ সালে শিশির ভাদুড়ী লালবাগে আসেন। তুলনামূলকভাবে জিয়াগঞ্জের নাট্যজগৎ অনেক বেশি সক্রিয় ছিলো। ১৯২৮-এর কাছাকাছি সময়ে ‘নাট্যভারতী’, ‘বালুচর ভারতী নাট্যসমাজ’ বেশ কিছুদিন ভালো প্রযোজনা উপহার দিয়েছে। আরেক ছিলো ‘রঙ্গবীর্য সংস্থা’- তারা ১৯৫৭ সাল থেকে নাট্যোৎসবেরও আয়োজন করতো। আধুনিক পরীক্ষামূলক নাটকের সূত্রপাত বোধহয় ১৯৬২-তে, যখন তৈরি হলো ‘বহুমুখী’ নাট্যসংস্থা’। অঞ্জন বিশ্বাসের পরিচালনায় জিয়াগঞ্জে ‘লক্ষ্মী টকিজে’ তাঁরা প্রযোজনা করেন রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’।

মুর্শিদাবাদের সামগ্রীক নাট্যপথে একটা বিষয় লক্ষ্য করার মতো- বর্তমানের সময়কালে দাঁড়িয়ে নাট্যইতিহাস সন্ধান করতে গেলে অধিকাংশ অঞ্চলেই দেখা যাচ্ছে বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে যেসব নাট্যকর্মের সূচনা হয়েছিলো- শতাব্দীর মাঝামাঝি এসে তার পথরেখা হারিয়ে গেছে।

বহরমপুরের নাটক থেকে কাশিমবাজারের নাট্যচর্চাকে আলাদা করা চলে না। ঊনবিংশ শতাব্দীর আলোচনায় কাশিমবাজারকে সবিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমানের শহর বহরমপুরের নাট্যইতিহাস আলোচনা এক সময়ের এ শহরের একমাত্র নাট্যমঞ্চ ‘গ্র্যান্ট হল’-এর কথা দিয়েই শুরু করা যেতে পারে। রাজপরিবার বা জমিদার পরিবারদের এই সমস্ত নাট্যকর্ম বহরমপুর শহরেও যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিলো নিশ্চয়। কেননা বিংশ শতাব্দীর  গোড়ার দিকে বহরমপুর শহরে দেখা যায় যে, জমিদার বা রাজপরিবারের পৃষ্ঠপোষকতার বাইরেও নাট্যদলের বিকাশ হতে থাকলো। প্রাথমিকভাবে অবসরপ্রাপ্ত যোসেফ ম্যারিয়ন সাহেবের মালিকাধীন একটি ডিম্বাকৃতি বিশাল বাড়ি ছিলো বর্তমান গ্র্যান্ট হলের জায়গায়। ১৮৯৭-এর ভূমিকম্পে সেটি ভেঙ্গে যাওয়ার পর লালগোলার রাজা মঞ্চসহ বর্তমান গ্র্যান্ট হলটি তৈরি করে দেন। এবার নাম হয় ‘এডওয়ার্ড রিক্রেয়েশন ক্লাব’। দ্বারোদ্ঘাটন হয় ১৯১১ সালে। ১৯৪৭ সালে আবার নাম পরিবর্তন করা হয়- ‘যোগেন্দ্র নারায়ণ মিলনী’। গ্র্যান্ট হলের ‘স্ট্রাড ডীড’-এ বলা ছিলো কোনো মহিলা শিল্পী এই মঞ্চে নাটক, সংগীত বা নৃত্যানুষ্ঠান করতে পারবে না। যদিও ১৯৫১ সালে ঐ সংস্থার সদস্যরাই ঐ নিয়ম তুলে দিয়েছেন। বহু নাটক মঞ্চস্থ করেছেন তারা। রাধাকান্ত সরকার, অমর নিয়োগী, রবি রায়, অমল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ অভিনেতা এখানে অভিনয় করতেন। এই সময়তো গ্র্যান্ট হল ছাড়া আর কোনো মঞ্চই ছিলো না বহরমপুরে। যদিও ক্রমে ক্রমে নাটকের দলের জন্ম হচ্ছিলো। ১৯১৪-১৫ সাল নাগাদ বহরমপুরে দুটি নাট্যদলের আবির্ভাব ঘটে- ‘অবৈতনিক নাট্যসমাজ’ এবং ‘কাশিনাথ থিয়েটার’। এদের প্রযোজনা ছিলো ‘বঙ্গে-বঙ্গী’। ১৯১৯ সালে স্বর্ণময়ী ক্লাব মঞ্চস্থ করলো ‘চন্দ্রগুপ্ত’ প্রযোজনা। বহরমপুরের বিশিষ্ট আইনজীবী এবং বহরমপুর পৌরসভার প্রথম সভাপতি বৈকুণ্ঠনাথ সেন ছিলেন নাট্যপ্রিয় ব্যক্তি। তার মৃত্যুর পর ১৯২৩ সালে তাকে স্মরণ করেই সৈদাবাদে গড়ে ওঠে ‘বি.এম ক্লাব’। এই ক্লাবের উদ্বোধন করেন মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী। ‘কর্ণার্জুন’, ‘ষোড়শী’, ‘কারাগার’ প্রভৃতি নাটক মঞ্চস্থ হয় তখন। এরা রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ও মঞ্চে এনেছিলেন। ১৯২৪ সালে ‘দূর্গাদাস’ প্রযোজনা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করলো ‘শশীভূষণ রিক্রিয়েশন ক্লাব’। ‘কণ্ঠহার’, ‘রমা’, ‘মুক্তির আলো’ এদের উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা ছিলো। এই সময়ে যারা বিভিন্ন দলে অভিনয় করতেন তারা হলেন- ভোলানাথ গুহ, ডঃ চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ষোড়শী মজুমদার, প্রফুল্ল মজুমদার, উপেন্দ্রনাথ সমজদার, যামিনী মজুমদার, নৃপেন্দ্রনাথ সর্বাধিকারী, অহিভূষণ মুখার্জী প্রমুখ নাট্যব্যক্তিত্ব। পরবর্তী সময়ে বহরমপুরে ব্যবসাভিত্তিক থিয়েটারও গড়ে ওঠে। ১৯৩১-৩২ সালে ঘাটবন্দরে আলি হোসেনের ঘোড়ার গাড়ির আস্তাবলে মটুরাপাড়ার ভূপেন চক্রবর্ত্তী ‘রাজলক্ষ্মী থিয়েটার’ গড়ে তোলেন। ভূপেন চক্রবর্ত্তী, নসীপুরের যতীনবাবু, বহরমপুরের তারাপদ চ্যাটার্জী, আশু দত্ত, নফর দাস প্রভৃতি শিল্পীবৃন্দ এখানে অভিনয় করতেন। ননী বালা, চারু বালা, জিয়াগঞ্জের রাধারাণী প্রমুখ মহিলা শিল্পীও অভিনয় করতেন এই মঞ্চে। এখানে প্রথম নাটক ‘ফুল্লরা’। পরবর্তী সময়ে ‘সিন্ধু গৌরব’, ‘সাজাহান’ প্রভৃতি নাটকও মঞ্চস্থ হয়। টিকেটের মূল্য ছিলো এক টাকা। অহীন্দ্র চৌধুরীও এই মঞ্চে অভিনয় করে গেছেন। বিভিন্ন নাট্যদলের এ পর্যন্ত আলোচিত নাট্যপ্রযোজনাগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, কলকাতার প্রযোজনাগুলোই ছিলো এদের লক্ষ্য। ১৯৩৪-৩৫ সালে শিশির ভাদুরী ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘আলমগীর’ প্রযোজনা নিয়ে বহরমপুর সফর করে গেছেন। তারও প্রভাব পড়েছিলো বহরমপুরের নাটকে। ১৯৪৪-এ ‘প্রগতি লেখক শিল্পী সংঘের’ সম্মেলন উপলক্ষে স্থানীয় সূর্য সিনেমা হলে মঞ্চস্থ হয় বিজন ভট্টাচার্য্য রচিত, উত্তরকালের দিকনির্দেশনাকারী প্রযোজনা হিসেবে চিহ্নিত, ভারতীয় গণনাট্য সংঘের ‘নবান্ন’ প্রযোজনা। কংগ্রেস সাহিত্য সংসদ ১৯৪৬-এ প্রযোজনা করলো মনোজ বসুর ‘ভুলি নাই’। নাট্যরূপ দিয়েছিলেন অরুণ দাশগুপ্ত। ষোড়শী মজুমদার, অতীন্দ্র মজুমদার, মঙ্গলময় মৈত্র, নিতাই বাগচী, ছন্দা বাগচি, কেয়া দাশগুপ্ত, হাসি দাশগুপ্ত প্রমুখ অভিনেতা-অভিনেত্রী এই প্রযোজনায় অভিনয় করেন। মহিলা চরিত্রে মহিলা শিল্পী নিয়ে আসার ক্ষেত্রে এরা প্রায় পথিকৃতের মতো কাজ করেন।

এরপর এ শহরের নাট্যপথের আরেকটি যুগান্তকারী ঘটনা দেখা যায়। বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দলের ছাত্র সংগঠনের ‘সারা বাংলা সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয় বহরমপুর সার্কাস ময়দানে। বিশিষ্ট সমাজতন্ত্রী নেতা সওকত ওসমানী, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. নীহারঞ্জন রায়ের উপস্থিতিতে অভিনীত হলো অতীন মজুমদার রচিত ‘আগামীকাল’ গীতিনাটক প্রযোজনা। মূল নাটকটির নাম ছিলো ‘জাগরণ’ কিন্তু মঞ্চস্থ করার জন্য পুলিশের অনুমতি না পাওয়ায় ‘আগামীকাল’ নামে সেটি অভিনীত হয়। ‘জাগরণ’ নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার সময়ে দলটির কোনো নাম ছিলো না। মাননীয় ত্রিদিব চৌধুরী প্রযোজনার পরেরদিন এই দলের নাম দেন ‘ক্রান্তি শিল্পী সংঘ’।

এলো পাঁচের দশক। জন্ম নিলো ভারতীয় গণনাট্য সংঘের মুর্শিদাবাদ জেলা শাখা। নেতৃত্বে সুধীন সেন। রণজিত গুপ্ত, মীরা গাঙ্গুলী, পঞ্চানন চট্টোপাধ্যায়, শিবানী রাহা, নির্মল চক্রবর্তী, কমল সমাজদার, সলিল ভট্টাচার্য, শান্তি মাহাতো, শেতা চন্দ প্রমুখ শিল্পীরা যোগদান এই সংঘে। ১৯৫৩-তে মীরা সিনেমা হলে প্রযোজিত হয় তুলসী লাহিড়ীর ‘ছেঁড়া তার’। ১৯৫৪-তে দাঙ্গা বিরোধী প্রযোজনা ‘মশাল’, ১৯৫৫ সালে নট ও নাট্যকার উৎপল দত্তের উপস্থিতিতে ‘মুক্তির উপায়’ প্রযোজনা বহরমপুরের নাট্যচর্চাকে অর্থবহ করে তুললো। পথনাটকেরও পথ দেখালো এই গণনাট্য সংঘ শাখা। পানু পালের ‘ভোটের ভেট’, কমল সমাজদরের ‘ধর্ম অবতার’, ‘যদি চিনিয়ে দেয়’ প্রভৃতি পথনাটক যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিলো। উল্লেখ্য, ১৯৫৫ সালে সুনীল দত্ত রচিত ‘হরিপদ মাস্টার’ নাটকটি তৎকালীন জেলাশাসক ১৮৭৬ সালের নাট্য নিয়ন্ত্রণের কালা আইনে বন্ধ করে দেন। সেসময়ে গণনাট্য সংঘের প্রযোজনাগুলো মানুষের কাছে যথেষ্ট আদৃত হয়েছিলো। ১৯৬০-৬১-তে রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ ও ‘শ্যামা’ প্রযোজনাও যথেষ্ট প্রশংসিত হয়েছিলো। কিন্তু সত্তুর দশকের শুরু থেকেই গণনাট্যের ঐতিহ্যপূর্ণ নাট্যচর্চা শিথিল হয়ে আসতে থাকে।

ইতোমধ্যে ১৯৫২ সালে লালদীঘি অঞ্চলে গড়ে উঠেছিলো ‘ড্রামা গিল্ড’। ঋত্বিক ঘটক রচিত এবং অবু ঘটক পরিচালিত ইংরেজি নাটকের প্রযোজনা ‘এ নাইট এ্যাট ইন্’ মঞ্চস্থ হয়েছিলো মীর সিনেমায়। বহরমপুরের নাট্যপথে ১৯৫৯ সালটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। স্বাধীন শিল্পসত্ত্বাকে স্বীকৃতি দিয়ে ‘ক্রান্তি শিল্পী সংঘের’ অধিকাংশ শিল্পী নতুন দল গঠন করলেন ‘রূপশিল্পী’। সেই সময়ের নিরীখে আধুনিক প্রযোজনা তরুণ রায়ের ‘রূপালী চাঁদ’ মঞ্চস্থ করে ‘রূপশিল্পী’ আবির্ভাবের শুরুতেই চমক সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলো। পরবর্তী প্রযোজনা বিনয় লাহিড়ীর ‘মাটির মায়া’ বা সলিল সেনের ‘সন্নাসী’ প্রযোজনাও অভিনয়ের পাশাপাশি মঞ্চ সজ্জার বৈচিত্র্য এবং আলোর ব্যবহারে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ‘রূপশিল্পী’ বহরমপুরের গ্রুপ থিয়েটার হিসেবে বলিষ্ঠভাবে নিজেদের অগ্রণী দল রূপে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলো। এলো ষাটের দশক। উপরোক্ত অনেক দল সক্রিয় থাকলেও, নতুন রক্তের অনুপ্রবেশের অভাবেই হোক বা নাটক ও নাট্যচর্চার সার্বিক পরিবর্তনের প্রভাবেই হোক, ষাটের দশকের শেষ থেকে ধীরে ধীরে পুরনো দলগুলো হয় অবলুপ্ত হতে থাকলো কিংবা তাদের নাট্যকর্ম কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়লো। এমনই একটা সময়ে নাটকের নতুন দিশা নিয়ে বহরমপুরে গড়ে উঠলো দুটি নাট্যদল- ‘ছান্দিক’ আর ‘প্রান্তিক’।

১৯৬৮ সালের জুলাইতে ছান্দিকের আত্মপ্রকাশ এবং ঐ বছরের ২৫ ডিসেম্বর জন্ম নিলো প্রান্তিক। ইতোমধ্যে ব্যক্তিগত অভিনয়কে আশ্রয় করে নাট্য প্রযোজনার দিন ফুরিয়ে আসতে শুরু করেছে। গ্রুপ হিসেবে অভিনয় শিল্পীদের সম্মিলিত নাট্যকর্মের নিরিখে থিয়েটারের ধ্যান-ধারণা স্পষ্টতর রূপ নিতে শুরু করেছে। আর এই গ্রুপ থিয়েটারের সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছেন পরিচালক। গল্পসর্বস্বতা নয়, নাটকের বক্তব্যই প্রধান বিবেচ্য এবং সেই বক্তব্য কোন পথে নির্দেশক মঞ্চে প্রকাশ করছেন- সেটাই প্রযোজনার মান হিসেবে চিহ্নিত হতে থাকলো। অর্থাৎ বাংলা থিয়েটার তখন হয়ে উঠেছে নির্দেশকের থিয়েটার। সেই প্রভাব পড়লো বহরমপুরেও। ছান্দিকের উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা ‘আসামী হাজির’, ‘সময়ের রঙ’, ‘রক্তকরবী’, ‘মে দিবস’, ‘দশমুণ্ডা’, ‘সক্রেটিস’, ‘নয়নের কবিরের পালা’, ‘অচলায়তন’, ‘মা’। প্রান্তিকের ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’, ‘দরজায় করাঘাত’, নানা হে’, ‘রক্তকরবী’, ‘চাকভাঙা মধু’, ‘রাজা’, ‘চার ইয়ারের পালা’ নতুনভাবে সাড়া ফেললো বহরমপুরে।

১৯৬৯-এ পুলকেশ মণ্ডলের নির্দেশনায় ‘বাণীচক্র’ নাট্যচর্চা শুরু করে। কিন্তু এই সংস্থাটিও স্থায়িত্ব পায়নি। ৭০-এর দশকের শুরুতে প্রচুর সম্ভাবনা নিয়ে গড়ে উঠলো ‘ঐক্যতান’। কিন্তু অচিরেই নির্দেশক স্বপন দত্ত ঐক্যতান ছেড়ে গড়ে তুললেন ‘দ্বান্দ্বিক’। ১৯৭২-এ ‘বহ্নি’ নাট্যসংস্থার জন্ম। বেশ কিছুদিন ধরে তারা নিজেদের মতো করে প্রযোজনা গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু নিয়মিত প্রযোজনার অভাবে আটের দশকের মাঝামাঝি বহ্নি নির্বাপিত হয়। ১৯৭৩-এ গোরাবাজারে আরও একটি সংস্থা ‘স্বস্তিক’ নাট্যজগতে প্রবেশ করে। গুটিকয় প্রযোজনার পর ‘স্বস্তিক’ বর্তমানে কাগজে-কলমে।

যখন ছান্দিক ও প্রান্তিক স্বমহিমায় নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে চলেছে তখন আবির্ভাব হয় নতুন এক দলের- ‘যুগাগ্নি’। ১৯৭৪ সালে অভিজিৎ সরকারের ‘অসমাপ্ত’ প্রযোজনা নিয়ে যাত্রা শুরু করলো একদল তরতাজা যুবক। নিষ্ঠা, চর্চা এবং আদর্শকে মূলধন করে তারা প্রযোজনা করে চললো ‘শিকার’, ‘খোদার মর্জি মজদুর সাথী’, ‘খণ্ডযুদ্ধ’। প্রাথমিকভাবে পম্পু মজুমদারের নির্দেশনায় এবং পরবর্তী সময়ে অভিজিৎ সরকারের প্রত্যয়ী প্রয়োগে ‘গণ্ডি’, ‘ঘুমের মানুষ’ ইত্যাদি প্রযোজনাও বিশিষ্টতায় উজ্জ্বল। কলকাতার নান্দীকারের অভিনেতা নির্দেশক গৌতম হালদারের নির্দেশনায় ‘মা অভয়া’ অসাধারণ জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। তাদের উল্লেখযোগ্য পথনাটকগুলোর মধ্যে ‘হত্যারে’, ‘হল্লাবোল’, ‘আমি মেয়ে’ উল্লেখযোগ্য। পরবর্তী সময়ে ‘অঙ্গিরা বাড়ি নেই’, ‘আক্রান্ত’ প্রভৃতি।

অন্যদিকে চুঁয়াপুর অঞ্চলে বেশ কিছু যুবকের উৎসাহে ১৯৭৬-এ সুহৃদ নাট্যসংস্থা জন্ম লাভ করে ‘মহাভারতের যুদ্ধ’, ‘নাজি চুয়াত্তর’ ইত্যাদি প্রযোজনা নিয়ে। পরবর্তী সময়ে ‘স্বরবর্ণ’, ‘তোতাকাহিনী’, ‘মনোরমা’ এদের উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা।

একই সময়ে আরও একটি নাট্যদল- ‘ঋত্বিক নাট্যগোষ্ঠী’-র যাত্রা শুরু হলো রাধারঘাট অঞ্চলে। ‘রাজদর্শন’, ‘অমৃত অতীত’, ‘অশ্বত্থামা’, ‘পদ্য-গদ্য-প্রবন্ধ’, ‘বিলাসী’ প্রভৃতি প্রযোজনা বলিষ্ঠভাবে মঞ্চে আনে ঋত্বিক নাট্যগোষ্ঠী। ১৯৮২ সালে দলটি ধারাবাহিকভাবে প্রতি বৃহস্পতিবার স্থানীয় বিমল কালচারাল হলে ‘বিলাসী’ নাটকটি মঞ্চস্থ করে। নাটকটির নির্দেশক ছিলেন অরুণ মুখোপাধ্যায়। ১৯৭৭ সালে শৈলেন বোসের নেতৃত্বে স্বর্ণময়ীর ‘মঞ্চে এলাম’ সংস্থাটি কিন্তু যথেষ্ট সম্ভাবনা নিয়ে নাট্যজগতে প্রবেশ করেছিলো। ‘হাঙ্গর’, ‘এই অক্ষে দাঁড়িয়ে’ প্রভৃতি নাটকে তারা নানান পরীক্ষা নিরীক্ষাও করেছে। কিন্তু দলটির নাট্যেদ্যোগ বেশিদিন গতিশীল থাকেনি- যেমনি থাকেনি ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত শিল্পী সংসদ-এর নাট্যচর্চা।

১৯৮০-তে প্রতিষ্ঠিত ‘সপ্তর্ষি’ অবশ্য এখনও টিকে আছে। ‘জন নাট্যসংস্থা’, ‘কল্যাণ নাট্যসংস্থা’, ‘অগ্নিসেনা’, ‘বি.এল.টি’- প্রমুখ দলগুলো জন্ম নেয় এবং অচিরেই অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে।

এই সময়টাতেই ‘ঋত্বিক নাট্যগোষ্টী’ থেকে বেরিয়ে ‘ঋত্বিক’ জন্ম নিল ১৯৮০ সালে। ঋত্বিক কিন্তু প্রথম থেকেই তার সৃজনশীলতার প্রমাণ দিতে থাকে। প্রথম দিকের নিবেদন ‘জামগাছ’, ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘গোরা’ দর্শক মনে দাগ কাটে। পরবর্তী সময়ে ‘কার্ল মার্কসের মৃত্যু’ শতবার্ষিকী স্মরণে গৌতম রায়চৌধুরী রচিত ও নির্দেশিত ‘কার্ল মার্কস’ প্রযোজনা তাদের দায়বদ্ধতার পরিচায়ক। ‘সীমাচৌহদ্দি’, ‘ব্যাস’, ‘আত্মবিম্ব’, ‘মেঘবতী’, ‘ভারত পুরাণ’, ‘দেশদ্রোহী’, ‘দিবারাত্রির কাব্য’, ‘ডাকঘর’ প্রভৃতি প্রযোজনা তাদের নিরীক্ষামূলক থিয়েটার ভাবনার পরিচয় বহন করে। ঋত্বিকও প্রসেনিয়াম থিয়েটারের পাশাপাশি মুক্তমঞ্চের নাটক প্রযোজনা করে থাকে। ‘রক্ততৃষা’, ‘৩০শে জানুয়ারি’, ‘অযোধ্যার লজ্জা’, ‘সাগর পাড়ের রাজকন্যা’, ‘যতুগৃহ’ ইত্যাদি মুক্তমঞ্চের নাটক একদিকে যেমন যথেষ্ট উন্নতমানের, অন্যদিকে তেমনি সময়ের প্রয়োজনেই নির্মিত। গৌতম রায়চৌধুরী প্রয়াত হওয়ার পর ‘শেষ রক্ষা’, ‘জাগরণ পালা’, ‘আদি রাজা’, ‘কঙ্কাল’ উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা। ২০০১ থেকে এক অনবদ্য ‘দেশ-বিদেশের নাট্যমেলা’ আয়োজন করে চলেছে এই নাট্যদলা। এই প্রবন্ধের লেখক এই নাট্যদলেরই গর্বিত সদস্য- আমরা ইতোমধ্যেই পরিচিত হয়েছি, বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তান, নরওয়ে, থাইল্যান্ড, ডেনমার্ক, জার্মান দেশের সমসাময়িক প্রযোজনার সঙ্গে এবং সেই সঙ্গে বহরমপুরের দর্শকবৃন্দের সুযোগ ঘটেছে বিভিন্ন দেশের উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা দেখার। এর পাশাপাশি নতুন ছেলেমেয়েদের নিয়ে সারা বছর থিয়েটারভিত্তিক ওয়ার্কশপ ও প্রযোজনা, স্কুলভিত্তিক ওয়ার্কশপ ও প্রযোজনা, বিশেষভাবে প্রশংসনীয়। এই বাংলায় দু-একটি দলের মতো আর এক ব্যতিক্রমী প্রয়াস ৩১ শে চৈত্র থেকে ১লা বৈশাখ ভোর ৫টা অবধি রাতব্যাপী নাট্যানুষ্ঠান ‘বর্ষবরণ’। এছাড়া তাদের মহলাকক্ষে গৌতম রায়চৌধুরীর স্মৃতি নামাঙ্কিত একটি প্রন্থাগার চালু করেছে। শৃঙ্খলাবদ্ধ, সনিষ্ঠ, সার্বিক থিয়েটার চর্চার এই উদ্যোগের জন্য ‘ঋত্বিক’ বহরমপুরের থিয়েটার চর্চায় পথিকৃৎ হয়ে থাকবে।

নাট্যকার ও নির্দেশক পম্পু মজুমদার ‘যুগাগ্নি’ থেকে বেরিয়ে আসা কয়েকজন শিল্পীকে নিয়ে ১৯৮৫ সালে গড়ে তুলেছিলেন ‘ধরিত্রী’। কিন্তু ‘হরতাল’, ‘আতর আলির রাজসজ্জা’ ইত্যাদি কয়েকটি প্রযোজনার পরেই ধরিত্রী হারিয়ে যায়। ১৯৮৪-৮৫ সালের ‘নবীন নাট্য’ সংস্থা’র জন্ম  সৈদাবাদ অঞ্চলে। ‘আতুয়া’, ‘ঢাকের বাদ্যি’ ইত্যাদি কয়েকটি প্রযোজনার পরই বোধহয় ‘নবীন’ নবীনতা হারিয়ে ফেলে। সন্দীপ বাগচীর নাট্যরচনা ও নির্দেশনায় ‘রাজা কৃষ্ণনাথ’ উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। অন্যদিকে ১৯৮৬-তে ‘বহরমপুর রেপার্টরী থিয়েটার’ জন্ম নিয়েছিলো মূলত প্রান্তিক থেকে বেরিয়ে আসা কিছু শিল্পীর সমন্বয়ে। যেহেতু এরা যথেষ্ট অভিজ্ঞতা এবং থিয়েটার ভাবনায় সমৃদ্ধ অভিনয় শিল্পী, তাই প্রথম থেকেই তাদের  প্রযোজনাগুলো যথেষ্ট উন্নতমানের ছিল। প্রদীপ ভট্টাচার্য নির্দেশিত ‘দংশন’ অসাধারণ নাট্যনির্মাণ হিসেবে চিহ্নিত। ‘তোতাকাহিনী’, ‘চাঁদসদাগর’ এবং সর্বোপরি ‘মায়া’ এদের বিশিষ্ট প্রযোজনা। বি.আর.টি-র সহযোগী হিসেবে এরা বহরমপুরে ‘রঙ্গাশ্রম’ নাট্য বিদ্যালয় স্থাপন করে। এই বহু প্রশংসিত প্রয়াস যদিও দু’বছরের বেশি টিকে থাকেনি। বি.আর.টি-এ থেকে বেরিয়ে এসে গৌতম মজুমদারের নেতৃত্বে ১৯৯৪-এ গড়ে উঠল ‘উজান নাট্যদল’। ‘আজকের সাজাহান’, ‘টিনের তলোয়ার’ ইত্যাদি প্রযোজনার নিরিখে এরাও নাট্যজগতের বিশেষ স্থান করে নিয়েছিলো, কিন্তু প্রযোজনার ধারাবাহিকতার অভাবে এই নাট্যদলকে সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে না।

নতুন শতাব্দীর শুরুতেই নতুন দল হিসেবে দেখা যায় ‘থিয়েটার বহরমপুর’কে। সন্দীপ ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ও নির্দেশনায়- ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’, ‘আত্মদাহ’ ইত্যাদি প্রযোজনার মাধ্যমে এরা বহরমপুর নাট্য পরিমণ্ডলে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠেছিলো। অবশ্য নানাবিধ কারণে এই গ্রুপটির কাজ আর দেখা যাচ্ছে না। যদিও সন্দীপ ভট্টাচার্যের ‘রঙ্গাশ্রম’ এই মুহূর্তে এই শহরে থিয়েটারের প্রশংসনীয় কাজ করে চলেছে। ২০১০ সাল থেকে নাট্যোৎসবেরও আয়োজন করে চলেছেন তারা। কয়েক বছরে চমকপ্রদ প্রযোজনা ‘মণিদীপা’, ‘মোবারক’, সন্তাপ’, ‘প্রতারক’ ইত্যাদি প্রযোজনা নিয়ে তরতাজা কিছু যুবক ‘রণ সংস্থা’ নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলো ২০০৮-এ। কৌশিক করের নির্দেশনায় ‘কুকুরের লেজ’, ‘বিলকিস্’ এবং ‘দৌড়’  উপহার দিলো সাফল্যের সঙ্গে। কিন্তু নানা-কারণে তাদের চলার গতি ধীর।

লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সত্তরের দশক থেকেই বহরমপুরের থিয়েটার চর্চার যে নতুন আঙ্গিক- নতুন ভাষার পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা নতুনতর প্রয়োগ-পদ্ধতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে- তার মূল কারণ, বহরমপুর শহর কলকাতার সফল নাটকের অনুকরণের অভ্যাস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে স্বকীয় ভাবনা-চিন্তাকে প্রাধান্য দিয়ে। সেই সঙ্গে বহরমপুরের নাচ্যচর্চায় প্রায়শই নতুন নতুন মৌলিক নাট্যসৃষ্টির প্রয়াস লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

এবার বলে নিই, বর্তমানে নাটকের একমাত্র মঞ্চ- স্থানীয় ‘রবীন্দ্রসদন’।

দুই বাংলার নাট্য দলের সখ্য

৮০-র দশকে মাঝামাঝি প্রান্তিকের আমন্ত্রণে প্রথম বাংলাদেশের ‘আরণ্যক নাট্যদল’  ‘ইবলিশ’ নাটক বহরমপুরে মঞ্চস্থ হয়। তারপর ১৯৯৫ সালে প্রথম ছান্দিক নাট্যদল তিনদিনের বাংলাদেশ সফল করে। এই দুই বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া নাট্য আদান প্রদানের কোনো যোগসূত্রতা ছিলো না। নাট্য আদান-প্রদান ধারাবাহিকভাবে যোগসূত্রতা রচনা করে ‘ঋত্বিক’- তাদের ‘দেশ-বিদেশের নাট্যমেলা’র আয়োজনের মধ্যে দিয়ে। গত ১৪ বছরে ঋত্বিকের আমন্ত্রণে বাংলাদেশের ২৬ টি  নাটক বহরমপুরে মঞ্চস্থ হয়েছে। পরবর্তী সময়ে যুক্ত হয়েছে ‘রঙ্গাশ্রম’ তাদের নাট্যমেলায় (গত পাঁচ বছর) ও ‘যুগাগ্নী’ তাদের পথনাটক উৎসবে। একইভাবে ঋত্বিক, রঙ্গাশ্রম ও যুগাগ্নী বাংলাদেশ সফর করেছে তাদের নিজেদের প্রযোজনা নিয়ে। ফলে আজ বাংলাদেশের নাট্যদল ও নাট্যকর্মীদের কাছে বহরমপুর একটি নাট্য বন্ধুত্বের শহর। ঋত্বিকের আয়োজনে বাংলাদেশের নাট্যদলের যুগান্তকারী আয়োজনে উদ্বুদ্ধ হয়ে কান্দি মহকুমার ‘ঝড়’ নাট্যগোষ্ঠী ও রঘুনাথগঞ্জের ‘নাট্যম বলাকা’-এর উৎসবে বিচ্ছিন্নভাবে বাংলাদেশের নাট্যদর মঞ্চস্থ করছে তাদের নাট্যসম্ভার। বহরমপুর আজ বাংলাদেশের নাট্যকর্মীদের অপার আবাসগৃহ। ইতিহাসের আরেক সাক্ষ্য বহন করবে বহরমপুর-এর থিয়েটার।

মুর্শিদাবাদ জেলার ও বহরমপুরের নাট্য ইতিহাসের এক রূপরেখা অঙ্কনের চেষ্টা হয়েছে মাত্র। তবে বেশিরভাগটাই তথ্যভিত্তিক। বিশ্লেষণ ও গবেষণার বিষয়টি গবেষকের বিষয়। গত চারদশকে অনেক অনেক সাড়া জাগানো প্রযোজনা বহরমপুরে মঞ্চস্থ হয়েছে। দুই বাংলার মৈত্রীর সেতু বন্ধনে বহরমপুরের ভূমিকা আজ অনেক বেশি উজ্জ্বল- হয়তো-বা কলকাতার চেয়েও প্রাণোচ্ছ্বল।

তাই তো এই বঙ্গে কোলকাতার পর নাটকের শহর বহরমপুর।

সুত্র ও সহযোগিতায়- মুর্শিদাবাদে নাটকের পথ চলা : শক্তিনাথ ভট্টাচার্য্য, ছান্দিক, বহরমপুর।

মোহিত বন্ধু অধিকারী : অভিনেতা, সম্পাদক- ঋত্বিক, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ, ভারত