Full premium theme for CMS
নাট্যঋষির অন্তর্ধানে
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
বাংলা নাটকের প্রবাদপুরুষ, মধ্যযুগের বাংলা নাটকের ছিন্নসূত্রের আবিষ্কর্তা, আমাদের গুরু ও শিক্ষক, গবেষক সেলিম আল দীন কি কেবলই স্মৃতি? না, স্মৃতির প্রবাহ? অত্যন্ত সন্তর্পনে সেলিম আল দীনকে একটি নাম দেয়া হয়েছিল, ‘নাট্যঋষি’। তিনি ঋষির মতোই ধ্যানমগ্ন হয়ে আমাদের নাটকের জন্য নিয়ে এসেছিলেন অগুণতি মণিমানিক্য। বাস্তবতই বলতেন, শরীর-মন যথাযথ রাখার জন্য লেখকদের আলাদা মেডিটেশনের প্রয়োজন হয় না। তিনি কি কেবলই তারকা? নাকি ঋষি তারকা? তারকা মণ্ডলের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র? এই ঋষিদের কখনো মৃত্যু হয় না। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সৃজনের পর থেকে সপ্তর্ষি মণ্ডলের কোন তারাটির পতন হয়েছে?
মানব মাত্রই জীবদ্দশায় কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে। এই রকম ত্রুটি-বিচ্যুতি বোধ করি সেলিম আল দীনেরও ছিল। তাঁর জীবনের অসঙ্গতিগুলোর জন্য আমরা তাঁকে সমালোচনা করেছি। আবার এও বলেছি, আপনি তো গ্রেটম্যান, গ্রেটম্যানরা আপনার মতো একটু-আধটু পাগলই হয়। আমরা যারা কৃপণ বলে তাঁকে অপবাদ দিয়েছি, অর্থাৎ সেলিম আল দীন প্রশংসা করতে জানেন না, তা’ এ মুহূর্তে কিঞ্চিৎ খণ্ডন করতে চাই। একটি ভালো লেখা কিংবা একটি মানসম্পন্ন নাট্য-প্রযোজনা সেটি যারই হোক, যে দলেরই হোক, সেটির প্রশংসায় তিনি পঞ্চমুখ হতেন। কোনো একটি লেখার দুই ছত্র পড়েই সেলিম আল দীন বুঝতে সক্ষম ছিলেন লেখাটি কতোটা মানোত্তীর্ণ। তাঁর কাছে লেখার বিষয়বস্তুর মতো আঙ্গিক এবং ভাষারও সমান গুরুত্ব ছিল। নাটক কাব্যময় হলে দোষ কোথায়, কিংবা একটি কবিতা নাটকীয়তায় ভরপুর হলে ক্ষতি কি? হয়েছি হিন্দু মুসলমান, মূল জায়গায় তো মানুষ।
কথায় কথায় বলে থাকি, আমরা নাকি দুর্ভাগা। কিন্তু দুর্ভাগ্য কাকে বলে এবার সত্যিকার অর্থেই টের পেলাম। এই দুর্ভাগা জাতির জন্য সেলিম আল দীন যে অবদান রেখে গেছেন তার প্রথম পাঠ হলো, তুমি তোমার নিজকে চেনো। তুমি কেন অন্যের দ্বারস্থ হবে, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ কি তোমার কম আছে? তোমার জন্য তুমিই যথেষ্ট। আজ আমার হাতে উপনিবেশের চাবুক থাকলে ইংরেজরা রবীন্দ্রনাথ পড়তো। কিন্তু ওদের হাতে চাবুক ছিল, তাই আমি শেক্সপীয়র পড়ি। গত বছর আমার যে নাট্যগ্রন্থটি (শিলারি) প্রকাশ পেয়েছিল, সেলিম আল দীন স্বপ্রণোদিত হয়ে সে গ্রন্থের মুখবন্ধ লিখেছিলেন। আবার নাট্যকার হিসেবে আমার বাচসাস পুরস্কার (২০০৫) প্রাপ্তিতে তিনি বেজায় খুশি হয়েছিলেন এ জন্য যে, তাঁর ঘরানার জয় হলো।
সেলিম আল দীন এক বিদ্রোহী যিনি প্রসেনিয়ামের দাসত্বকে অস্বীকার করেছিলেন। সেলিম আল দীন এক বিজ্ঞানী যিনি নাটক নিয়ে নিয়ত পরীক্ষা নিরীক্ষায় নিজকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন। তিনি এক ভাষা-বিজ্ঞানী, যিনি নাটক লিখে লিখে নিজের জন্য একটি আলাদা ভাষা নির্মাণ করেছিলেন। তিনি এক স্থপতি যিনি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব নামে আলাদা বিভাগ স্থাপন করেছিলেন। সেলিম আল দীন এক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, যিনি বিগত কয়েক বছরে, বিশেষ করে ইরাক যুদ্ধের পর থেকে রাষ্ট্রের ভূমিকা এবং দায়িত্ব নিয়ে চিৎকার করতে করতে কন্ঠ রুদ্ধ করেছিলেন। তিনি খড়গহস্ত ছিলেন বিশ্বায়ণ ও বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে। বিশ্বব্যাপী দাঙ্গা এবং যুদ্ধের ভয়াবহতা তাঁকে ব্যথিত করেছিল। এই দুঃখ এবং বেদনা কেবল তাঁর লেখা এবং সৃষ্টিকর্মে প্রতিফলিত হয়েছিল এমন নয়, তাঁর শরীর এবং মনেও এর প্রতিফলন দেখা যায়। তাঁর মন ভেঙে গেল, শরীর দুমড়ে গেল। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আমরা এমন এক আপনজনকে হারালাম যিনি শেকড় সন্ধান করতে করতে নিজেই শেকড়ে পরিণত হয়েছিলেন।
অনেকেরই এ শেকড়ের প্রতি ভীতি ছিল। এ শেকড় এক শক্তির নাম। এ শক্তি কিসের? মানুষের, না তার সৃষ্টির? সে যা-ই হোক, লক্ষ্য করেছি তাঁর মৃত্যুর পর এ ভয় বেড়ে যায়। আবার এ শক্তির আকস্মিক পতনে এতোগুলো মানুষ এক সাথে কেঁদে উঠলো। দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হয় এ ক্রন্দন। কখন থামবে জানা নেই। আপাত অশ্রুপতন বন্ধ হলেও হৃদয়ের রক্তক্ষরণ প্রলম্বিত হয়। এক কবিতায় নাজিম হিকমত বলেছিলেন: বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর। এটি একবিংশ শতাব্দী। কালের আয়ু কি মানুষের শোকের আয়ুকেও বর্ধিত করছে?
তিনি বাজারকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, বাজারও তাঁর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। বাজারবিমুখতার কারণে সহজে তাঁর বই প্রকাশ পেতো না। প্রকাশনার জন্য তিনি সৃজনশীল ও উদ্যোগী আপনজনদের মুখের দিকেই চেয়ে থাকতেন। নাটক মাত্রই বই হিসেবে বাজার মন্দা, যদিও মঞ্চে সে পরাক্রমশালী। তাঁর প্রতিটি নাটক মঞ্চসফল হলেও জীবদ্দশায় একটি বইও ‘হট কেক’ হয় নি। দর্শক-শ্রোতা ও পাঠক ভিন্ন সত্তা।
কীভাবে গঠিত হয়েছিল তাঁর মনন? এতে ছিলই বা কি? শিক্ষক হিসেবে তাঁর সংবেদনশীলতা অতুলনীয়। অস্বচ্ছল ছাত্রদের প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেছেন। মানবিকতার সন্ধিক্ষণে চোখের জল এমনি এমনি ঝরে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ছিল তাঁর অতিপ্রিয়। এর প্রাকৃতিক পরিবেশ ও নৈসর্গিকতা তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তিনি এর অংশে পরিণত হয়েছিলেন। বললাম, এ মায়া ধাম অ্যাক্সপ্লয়েট করে আপনি হলেন নাট্যকার। তা’ তো বটেই, বনপাংশুল নাটকের বনে এক রাত্তিরে কোত্থেকে প্রকাণ্ড ফড়িং এসে বসেছিল। ঢাকা থিয়েটারের নাটকেই এ চিত্রকল্প শোভা পায়। প্রকৃতি সংলগ্নতার মতোই তাঁর ছিল গণভিত্তি। গ্রাম থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করে তিনি হলেন গণমানুষের নাট্যকার।
ভাগ্য দুর্ভাগ্য হাত ধরে চলে। নিজে হতভাগ্য কম ছিলেন না। পুত্র মাইনুল হোসেনের অকাল মৃত্যু তাঁকে আজীবন ব্যথিত করেছিল। এ শূন্যতা পূরণে কতজনকে লালন করেন, শ্যালিকা কন্যা অন্বিতা শেষ সম্বল। সেও কর্কট ব্যাধিতে আক্রান্ত। কন্যাকে বাঁচানোর সেই কী আকুতি তাঁর। সাহায্য চেয়ে পত্রিকায় কলাম, টেলিভিশন প্রতিবেদন কিংবা স্বর্ণবোয়াল এর আহ্বান চোখে পড়ে: এ গ্রন্থের লেখকস্বত্বের অর্থ আমার কন্যাধিক অন্বিতার দূরারোগ্য ক্যানসার রোগের চিকিৎসায় ব্যয়িত হবে। তিনি ভাগ্যবান এ অর্থে যে, স্ত্রীর কাছে ছিলেন প্রাণাধিক। পত্নী পতিকে এতো ভালোবাসতে দেখি নি। সে-জন্য অর্থের প্রয়োজনে তাঁর মিডিয়ায় গমনাগমন ভাবীর পছন্দ ছিল না। মিডিয়ার কারণে মৌলিক লেখার পরিমান হ্রাস পাওয়া গুরু জায়া গ্রহণ করতে পারেন নি। কি প্রয়োজন অর্থকড়ির, স্ত্রীর চাহিদা না থাকলে স্বামীর ব্যস্ত হওয়ার দরকার পড়ে কি? আমার প্রয়োজন কেবল মানোত্তীর্ণ রচনার। আমি তো এই সেলিম আল দীন চাই নি। এ সব কথা বলে বেগমজাদী মেহেরুন্নেসার চোখের জল বাঁধ মানে নি। তাঁকে প্রবোধিত করার ভাষা পাই না। অবশেষে বললেন, আমার এ যাতনার কথা অন্য কাউকে বলো না ভাইটি। তোমরা তার অনুসারী, নিষেধ করলে শুনতেও পারে।
গত গ্রীষ্মের এক বিকেলে স্ত্রী-কন্যা-পুত্র সহযোগে তাঁদের আবাসে গমন করি। নাট্যকার অনুপস্থিত, আলাপের এক ফাঁকে ভাবীর মুখে ফুটে উঠে সুদূরবর্তী স্বপ্নের কথা। নাট্যকার না থাকলে তাঁর ব্যবহৃত দ্রব্যাদি, বই পুস্তক দিয়ে ‘সেলিম আল দীন সংগ্রহশালা’ বানাবেন। টেবিলের উপর পুরো ওয়েলক্লথ বিছিয়ে রেখেছেন যাতে বিড়ির জ্বলন্ত ছাইয়ে কাঠ না পুড়ে যায়। তিনি লিখবার-কালে অনেক সময় ছাইদানীতে না ফেলে ভস্মটা যেখানে সেখানে ফেলতেন, টেবিলের উপরও। সংগ্রহশালার জন্য সব দ্রব্য নিখুঁত রাখার কতো না দৃঢ় সংকল্প। কিন্তু এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে এতোটাই তাড়াতাড়ি হাত লাগাতে হবে তা’ তো ভাবি নি। স্বপ্ন অতোটা তাড়াতাড়ি সাড়া দিল? আহা পারুল বোনটি আমার!
যে যা-ই বলুক, লক্ষ্য করেছি মরণের জন্য তাঁর দীর্ঘ প্রস্তুতিই ছিল। পঞ্চাশ পেরোতেই শরীরে নানা লক্ষণ ফুটে উঠে। তাই হাসান শাহরিয়ারের ম্যাসেজ পেয়ে নিজে অন্তত বিস্মিত হই নি। এক সময় লক্ষ্য করি তাঁর সকল খাম-খেয়ালীপনা হ্রাস পায়, এক ধূমপান ছাড়া। তবে লেখার হাত সচল থাকে। কী শক্তিমান পুরুষ! গত তিন বছরে কখনো রাত ১০টায় ফোন করলেও পাই নি, বিছানায় চলে গেছেন। রীতিমতো ওষধ সেবন ও আহার-নিদ্রা করেন। কতো যে সচেতনতা। মনে মনে ভাবি নিশাচর সেলিম আল দীনের এই হাল!
আমাদের সকল ভাবনার অবসান ঘটিয়ে তাঁর হৃৎস্পন্দন থেমে গেলো। হাজার মানুষ কাঁদিয়ে দু’রাতের জন্য আশ্রয় নেন হিমঘরে। তিনি বেরিয়ে এলে সেলুলয়েডবন্দী চাকা-র মতো শববাহী চাকাও ঘোরে। চাকা-র মালিক চাকাতে শোয়। তাঁর শব নিয়ে এগিয়ে চলে শকট। তাঁর নাকের তুলো আমার সহ্য হয় না। সহস্র মানবের পদভারে কম্পিত মৃত্তিকা। আমরা তাঁর উদ্দেশ্যে কোনো ভাষা খুঁজে পাই না। আমার হৃদয়ের কাছাকাছি এক ছাত্রীর পরিয়ে দেয়া কালো ব্যাজের সাদা লেখায় বিক্ষিপ্ত চিন্তা থমকে দাঁড়ায়,- ‘হে স্বর্ণকবি, আমাদের চিত্তের রক্তক্ষরণে রচিত শোকমালা উৎসর্গীকৃত তোমার জন্য।’
আমার যদি জন্ম হতো কালিদাসের কালে, এই রকম কথা বলে রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত আফসোসই করেছিলেন। আমার যদি জন্ম হতো সেলিম আল দীনের কালে- এ কথা বলে আমাদেরকে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয় নি। আমরা সেলিম আল দীনের কালে জন্মেছি, এইটুকু সান্ত্বনা তো আছে? এই সান্ত্বনা এবং আত্মতৃপ্তি নিয়েই আমরা বেঁচে থাকবো আর একটি কালে যাত্রা করবার জন্য।
গোলাম শফিক: নাট্যকার, নাট্যকর্মী, সমালোচক, সদস্য- পালাকার