Full premium theme for CMS
মঞ্চালোকের উদ্দেশ্য
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
অনুবাদ: মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন
আধুনিক নাট্য প্রযোজনায় আলো প্রায় অনিবার্য। নাট্যালোকের জ্ঞান যে শুধু আলোক পরিকল্পকের বিষয় তা নয়, বরং নাট্যকার নির্দেশক, অভিনেতাসহ প্রযোজনার সাথে জড়িত অন্য সকলেরও এ সম্পর্কে জানা থাকা প্রয়োজন। আলোর মৌলিক জ্ঞান থাকলে একজন নাট্যকার বুঝতে পারবেন - আলো দিয়ে তার নাটকে কী সৃষ্টি হতে পারে না-পারে। এতে নাটকের দৃশ্যকল্প নির্মাণে নাট্যকারের সুবিধা হয়। আবার সেট কিংবা পোশাক পরিকল্পকও বুঝে নিতে পারেন আলো তার পরিকল্পিত সেট বা পোশাকে কী কী সুবিধা-অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে।
আলোক সম্পাতের বিভিন্ন বিষয়াবলীর মধ্যে আলোর উদ্দেশ্য অন্যতম প্রধান একটি বিষয়। এ প্রবন্ধে আমরা সেটিই আলোচনা করব।
মঞ্চালোকের উদ্দেশ্য বহুবিধ। তবে প্রধান উদ্দেশ্য ৫ টি:
১. মঞ্চ উপস্থাপনা দর্শককে দেখানো নিশ্চিত করা যা আমরা ‘আলোকিতকরণ’ শিরোনামে আলোচনা করব।
২. মঞ্চে (যদি প্রয়োজন হয়) বাস্তবধর্মী পরিবেশ সৃষ্টি করা, এর শিরোনাম হবে ‘বাস্তবানুগতা ’।
৩. প্রযোজনার নির্বাচিত অংশকে ফুটিয়ে তোলা, শিরোনাম ‘পরিকল্পিত বিন্যাস’।
৪. আলোর মাধ্যমে মনস্তাত্ত্বি¡ক বিভিন্ন বিষয়াদি পরিস্ফুট করা, আলোচিত হবে ‘আলোর মনস্তত্ত্ব’ নামে।
৫. আলোক প্রক্ষেপনের মাধ্যমে বস্তুর ত্রিমাত্রিক গুণাগুণ অবমূক্ত করা, শিরোনাম হবে ‘ত্রিমাত্রিকতা’।
১. আলোকিতকরণ:
থিয়েটার হচ্ছে দৃশ্যকলা। সেজন্য মঞ্চ উপস্থাপনাকে দৃশ্যমান করাই আলোর প্রথম উদ্দেশ্য। এ লক্ষ্যে আলোক সম্পাতের বহুবিধ যন্ত্রপাতি প্রযোজনার সাথে সম্পৃক্ত হতে পারে। এটা খুবই স্বাভাবিক যে, যতবেশি লাইট সংযুক্ত করা হবে মঞ্চ তত বেশি আলোকিত হবে। আলোর সুষম বিন্যাস এবং পরিকল্পনার কাজকে সুশৃঙ্খল করার জন্য মঞ্চকে কাল্পনিক কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। বিভাজনগুলো নিুরূপ:
UP UP UP
RIGHT CENTRE LEFT
MIDDLE MIDDLE MIDDLE
RIGHT CENTRE LEFT
DOWN DOWN DOWN
RIGHT CENTRE LEFT
মঞ্চের এই বিভাজন মঞ্চের আকৃতি অনুসারে কম-বেশি হয়ে থাকে। অর্থাৎ ছোট মঞ্চ হলে ভাগ কম হয় আর বড় মঞ্চ হলে বেশি হয়। মঞ্চে কোনো কিছু দৃশ্যমান করার সময় উক্ত বিষয়াদি মনে রাখলে আমাদের সুবিধা হবে।
মঞ্চে কোনো কিছু দৃশ্যমান করার সময় আরও তিনটি বিষয় মনে রাখা দরকার:
ক) মঞ্চ থেকে দর্শকের দূরত্ব : মঞ্চ উপস্থাপনাকে দৃশ্যমান করার জন্য কী পরিমান আলো ব্যবহৃত হবে তা দর্শক সারি থেকে মঞ্চের দূরত্বের উপর নির্ভর করে। সাধারণত বড় আকৃতির প্রেক্ষাগৃহে সম্মুখ মঞ্চ বা এ্যাপ্রোণ থেকে দর্শকের প্রথম সারির দূরত্ব ২৫ ফুট এবং শেষ সারির দূরত্ব ২৫০ ফুট হয়ে থাকে। মধ্যমাকৃতির প্রেক্ষাগৃহে এই দূরত্ব প্রথম সারির জন্য ১২-১৫ ফুট এবং শেষ সারির জন্য ৬০-৭০ ফুট হয়ে থাকে। একইভাবে স্টুডিও থিয়েটারের ক্ষেত্রে প্রথম সারি ৪-৫ ফুট এবং শেষ সারি ২-২৫ ফুট দূরে অবস্থান করে। উল্লেখ্য, প্রয়োজনের তুলনায় বেশি বা কম আলো দর্শকের চোখে বিরক্তির কারণ হতে পারে।
খ) মঞ্চের আকৃতি: মঞ্চের আকৃতির তারতম্যে আলোর তারতম্য ঘটে। ২৫ ফুট প্রশস্থ এবং ১৫ ফুট গভীর একটি মঞ্চ আলোকিত করতে যে পরিমান আলো ব্যবহার করা হবে, ৪০ ফুট প্রশস্থ এবং ৩০ ফুট গভীর একটি মঞ্চে সে পরিমান আলো ব্যবহার করা হয় না; তারতম্য ঘটে।
গ) পশ্চাদপটের সাথে বৈপরীত্য: মঞ্চে একজন অভিনেতা কী রঙের পোষাক পরে, কী রঙের পর্দা (অথবা অন্য কিছু)-র সামনে দাঁড়াচ্ছে তা-ও আমাদের ভাবতে হবে। যেমন- পেছনের পর্দা যদি সাদা হয় আর অভিনেতার পোষাক যদি কালো হয় তাহলে যে পরিমান আলো ব্যবহৃত হবে একই পর্দার সামনে সাদা পোষাক পরে দাঁড়ালে তার চাইতে বেশি আলো প্রয়োজন হবে।
উক্ত তিনটি ক্ষেত্রেই আলোর পরিমান বলতে আলো/ লাইটের সংখ্যা এবং আলোর তীব্রতা (ওয়াট) এর কথা বোঝানো হয়েছে।
২. বাস্তবানুগতা:
বাস্তবানুগতা সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য; কেননা এটা মানুষের অভিজ্ঞতার কাছাকাছি। সেজন্য আলোক সম্পাতে বাস্তবানুগ আবেদন সৃষ্টি করা আলোকসম্পাতের একটি সাধারণ রীতি। প্রযোজনাটি যদি বাস্তবধর্মী হয় তাহলেতো বটেই, বাস্তবধর্মী না হলেও বাস্তব জীবনে ঘটে এমন কোনো আবেদনকে বিবেচনায় রেখে আলোর আবেদন সৃষ্টি করা পরিকল্পকদের জন্য সুবিধাজনক। যেমন- পেছনের সাদা পর্দা (সাইক্লোরমা) অথবা মঞ্চে নীল আলো দিয়ে গভীর রাত, সবুজেনীল আলো দিয়ে চাঁদনী রাত, দরজা বা জানালার আদলের মধ্যে দিয়ে কমলা রঙের আলো দিয়ে সূর্যাস্তের বহুল ব্যবহার আমরা দেখি এবং অতি সহজে গ্রহণও করি। কারণ, এগুলো আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতার সাথে সম্পৃক্ত। দিনের জন্য বেশি আলো এবং রাতের জন্য কম আলোর ব্যবহারও একটি অতি পরিচিত পদ্ধতি। এভাবে রঙ ও তীব্রতার পরিবর্তন করে বাস্তবানুগ বহু আবহ আমরা মঞ্চে পুনরুৎপাদন করতে পারি।
রাত বা অন্ধকার স্থানের আলোক উৎস হিসেবে বৈদ্যুতিক বাতি, মোম, হ্যারিকেন, প্রদীপ, মশাল ইত্যাদিকে বিবেচনায় রেখে আলোকসম্পাত আরেকটি প্রতিষ্ঠিত রীতি। এগুলোকে ‘ক্রিয়াশীল উৎস (Motivating Source)’ বলা হয়। তবে এসব ক্ষেত্রে ঐ উৎসের প্রকৃত আলোর তীব্রতা মঞ্চের জন্য পর্যাপ্ত না-ও হতে পারে। সেক্ষেত্রে উৎসের আলো-কে বিস্তৃত করে উদ্দেশ্য সাধন করা হয়।
৩. পরিকল্পিত বিন্যাস:
আজকের দিনে আলো-কে আমরা আর সংখ্যার বিচারে নয় বরং গুণের বিচারে গ্রহণ-বর্জন করি। অর্থাৎ লাইট কোথায় স্থাপিত হলো, কোন উৎসের পর কোন উৎস ব্যবহৃত হলো এবং সেটা কতটা নান্দনিক ও অর্থপূর্ণ হলো তা আমরা বেশি দেখি। তাই এর পরিকল্পিত বিন্যাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আলোর বিন্যাসে ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি। যদিও সর্বজনীন একটি ভারসাম্য নীতি রক্ষা করা খুবই কঠিন কাজ তথাপি প্রত্যেক পরিকল্পককে-ই তাঁর পরিকল্পনায় নিজস্ব একটা ভারসাম্য নীতি মেনে চলতে দেখা যায়। এখানে ভারসাম্য বলতে মঞ্চের ডান দিকে ও বাম দিকে সমান সংখ্যক স্থাপন করা নয় বরং প্রযোজনার প্রয়োজনীয় বিষয়াদি যথাযথ গুরুত্বের সহিত আলোকিত হল কি-না, আলোক প্রক্ষেপনে সুশৃঙ্খলা অনুভূত হল কি-না তা বোঝানো হয়েছে।
অনেক সময় নাট্যের বিশেষ কোনো মুহূর্তে বিশেষ কোনো চরিত্র, বস্তু, ক্রিয়া বা ঘটনার উপর আলোর মাধ্যমে জোর দেয়া হয়। এই ‘বিশেষ’ হতে পারে- একটি তৈলচিত্র, একটি বই’র তাক, একটি আগ্নেয়াস্ত্র, একটি টেলিফোন, একজন পুরনো ভৃত্য, চরিত্রের কোনো অঙ্গভঙ্গী ইত্যাদি। একে বলে ঊসঢ়যধংরং। এটা করা হয় সাধারণত ঐ বস্তু, চরিত্র ইত্যাদির উপর আলো রেখে মঞ্চের অন্য সব কিছুকে অন্ধকার করে অথবা অন্য সব কিছুর উপর আলো কমিয়ে দিয়ে। প্রশ্ন করা যেতে পারে-এটা কেন করা হয়? জবাবে বলা যাবে- Emphasis-এর মাধ্যমে আমরা নাটকের কোনো ঘটনা-সূত্র অথবা কোনো পারিবারিক প্রেক্ষাপট অথবা কোনো চরিত্রের আর্থ সামাজিক অবস্থান ইত্যাদির দিকে দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি। নাট্যানুষ্ঠানে Emphasis স্থানান্তর হতে পারে। একে Shifting of Emphasis-বলে। Shifting of Emphasis নিম্নোক্ত মঞ্চ নক্সা অনুযায়ী ১>২>৩>৪ নিয়মে হতে পারে আবার ১>৪>২>৫>৩>৪ কিংবা ৫>৩>১>৪>২>৫ ইত্যাদি বিভিন্ন নিয়মে হতে পারে।
১ ২ ৩
৪ ৫ ৬
৭ ৮ ৯
আলোর বিন্যাস প্রযোজনার ধরনের উপর নির্ভর করতে পারে। যেমন- সাধারণত করুণ রসাত্মক নাটকে আলো-ছায়ার সমন্বিত বিন্যাস এবং হাস্যরসাত্মক নাটকে আলোর উজ্বল বিন্যাস দেখা যায়। আবার চাহিদা ও পরিকল্পনা সাপেক্ষে হাস্য রসাত্মক নাটকেও আলো-ছায়ার লুকোচুরি ঘটতে পারে।
মনে রাখা দরকার- নাট্যানুষ্ঠানে দর্শকের উপর আলো থাকা-না থাকাও পরিকল্পত বিন্যাসের অংশ।
৪.আলোর মনস্তত্ত্ব:
প্রতিদিনের জীবনে আমরা-
-উজ্জ্বল আলোতে উৎফুল্ল হই
-হালকা আলোতে শান্তিপূর্ণ অনুভূতি পাই
-ফ্যাকাশে আলোতে অন্তঃচাপ অনুভব করি
-অন্ধকারে ভীত হই
এসব অনুভূতিকে বলে আলোর মনস্তত্ব। ক্রমাগত নিরীক্ষা ও অভিজ্ঞতা সাপেক্ষে দেখা যায়- বিভিন্ন ধরনের আলো, ছায়া এবং রঙের ভিন্ন ভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন- উজ্জ্বল আলো জীবন ও আনন্দের, আর অন্ধকার রহস্য ও মৃত্যুর মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। ছায়া উৎপাদক আধো আলোকিত মঞ্চসজ্জা (নাটকের সেট) মৃত্যুর পূর্ব ছায়াময় অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে। আবার স্পট লাইটের তীব্র আলোক বৃত্তে মানুষ অথবা বস্তুর একাকী অবস্থান রহস্যময় অনুভব সৃষ্টি করে। নীল আলো স্নাত সাদা পর্দা শান্ত পরিবেশ তৈরি করে আর লাল আলোর স্নানে সেটি দিতে পারে সন্ত্রস্ত ও বিপদের অনুভূতি। এভাবে মঞ্চেও আলো নানা ধরনের মানসিক আবহ সৃষ্টি করে।
স্পট লাইট এবং ডিমার আবিস্কারের ফলে আলোর উপর আমাদের প্রভূত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্পটের আলোতে কোনো অভিনেতা বা কোনো বস্তুকে বিভিন্ন অবস্থানে রেখে আলোর তারতম্যের মধ্যে দিয়ে- Profile (কৈণিক অবস্থান), Contour (বর্ণালী নক্সা), Silhouette (ছায়া নক্সা), Photographic sharpness (আলোকচিত্রানুগ তীব্রতা)- ইত্যাদি তৈরি করে নানা আবেদন সৃষ্টি করতে পারে।
৫. ত্রিমাত্রিকতা:
থিয়েটার হচ্ছে একটি সজীব ত্রিমাত্রিক শিল্পমাধ্যম। সুতরাং এর ত্রিমাত্রিক গুণাগুণ ফুটিয়ে তোলা অতি জরুরি।
বস্তুর ত্রিমাত্রিক আয়তন দৃষ্টিগ্রাহ্য করার জন্য এর গভীরতা ফুটিয়ে তুলতে হবে। এ কাজে আলোর সাথে ছায়ার উপস্থিতি আমাদেরকে বিশেষভাবে সহযোগিতা করবে। যেমন- মঞ্চে একটি কুড়েঘর রেখে সেটির সরাসরি সামনে থেকে আলো ফেললে কুড়েঘরটি দেখা যাবে ঠিকই, কিন্তু একে অগভীর বা থেতলানো মনে হবে। পক্ষান্তরে কুড়েঘরটির একপাশ থেকে বা পেছন থেকে আলো ফেললে এর কিছু অংশ আলো এবং কিছু অংশ ছায়ায় ভরে উঠবে। এতে করে ঘরটির অগভীর বা থেতলানো ভাব দূর হবে, ঘরটি ত্রিমাত্রিক হয়ে উঠবে।
উক্ত আলোচনায় দেখা যাচ্ছে মঞ্চালোকের উদ্দেশ্য হচ্ছে- দৃশ্যমান করা, বাস্তবানুগ আবেদন তৈরি করা, পরিকল্পিত বিন্যাস সৃষ্টি করা, মনস্তত্ত্ব ফুটিয়ে তোলা এবং ত্রিমাত্রিক গুণাগুণ অবমুক্ত করা। মনে রাখা দরকার- কৌশল কী সেটা আমাদের বিবেচ্য নয়; আমাদের প্রয়োজন প্রয়োজনীয় আবেদন ফুটিয়ে তোলা।
মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন : লাইট ডিজাইনার, জাতীয় নাট্যশালা, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী