Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

বঙ্গবালা নাজমা আনোয়ার : অয়ি পেশল সুষমাময়ী

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

নাজমা আনোয়ারকে মঞ্চে দেখলে বিস্ময় জাগতো! এ কোন নারী নাগরিক ঘেরাটোপে! যেন কতকালের যৌথ অবচেতন ফুঁড়ে প্রত্ন মাতৃমূর্তিকা আবির্ভূতা- বড়ই বেমানান দেশ-কালে। সুলতানের ছবির নারী বুঝি বাস্তব আদলে দণ্ডায়মান! এমনই লাগতো। গ্রামদেশে কখনো সখনো দেখা যোগিনী খনার সহোদরা যেনবা। চিরকালের বীর্যাবতী বঙ্গবালা! নাগরিক মঞ্চের সাধ্য কী তাকে ধারণ করে! তার চেষ্টাও কি হয়েছে তেমন? ‘আরণ্যক’ নামের মধ্যে একটা আশা যদিও জাগতে চাইতো, তবুও তা বুঝি আমাদের আয়ত্তের অতীত। আদ্যাশক্তির সেই স্বদেশী পরাক্রম করেইতো হারিয়ে খুইয়ে নিঃস্ব হৃতবল ন্যূব্জমুখ নাগরিক সমাজ। নারী যার কাছে ভোগ্যপণ্যা মাত্র। বিশ্বজোড়া বাজার-বিজ্ঞাপনের কামধনুবিশেষ- অনন্তদোহনে ফেনায়ে উঠেছে ভোগবিকার তাই।

নাগরিক নাট্য ও সংস্কৃতি নারীর এই পতিতায়নের মুখোমুখি হওয়াকে তার আত্মরক্ষার দায় হিসেবে নিয়েছে কি? এক ভুক্তভোগী নাট্যজন তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার নিরিখে বলেন বটে : একদিন বিনোদিনী দাসীর দল মঞ্চে যুক্ত হয়ে নবজন্মের মুক্তির আশ্বাস পেতেন, আর আজ, সুস্থ মুক্ত হাওয়া বিকিয়ে বাজারপঙ্কের সেবাদাসীত্বে স্বেচ্ছাব্রতীর দল ‘বাবু ধরা’ প্রতিযোগিতায় মত্ত মরিয়া!- এই হলো আজিকার বিশ্বে নারীর পরিণতি। দেশকালের নীতি-রাজনীতি-মনুষ্যত্বের সমূহদশায় বুঝি অনিবার্য এই নিয়তি।

অথচ নন্দন সংস্কৃতির রুচির লড়াইতো বাজারের এই সর্বস্বনাশা তাণ্ডবের বিরুদ্ধে- প্রতিষেধক আয়ুধ সন্ধানের অভিযাত্রা। তাই নয় কি?

গ্রামসমাজে আজও তো এই লড়াইয়ে অপ্রতিহত শিল্পী সুজন-সখীর দল। এইতো সেদিন দেখা এক পালায় নারীর পাল্লাভারি। লখিন্দরও সেজেছিল এক নারী! কী তার অর্ধনারীশ্বর শক্তিমত্তা! দেখে লজ্জায় চোখ কান কাটা যায়। নাগরিক নপুংশক এই আমরা কোথায় মুখ লুকাই! মঞ্চ-মিডিয়ার অন্তহীন ছেনালীতে ডুবতে ভাসতে, কামকেলী ক্রীড়ায়? ‘যাত্রা’র সর্বনাশা তো এই আমাদেরই কীর্তি।

কলকাতার ঊষা গাঙ্গুলী দেখি অন্য এক ঝংকার তোলেন মঞ্চে- যদিও তিনি বাঙালি নন। তৃপ্তি মিত্র, শোভা সেন, কেতকী দত্ত, মায়া ঘোষ, কেয়া চক্রবর্তী তো বাঙালি ছিলেন। শাঁওলী মিত্র, স্বাতীলেখা আজো আছেন। ঢাকার মঞ্চে আছেন ফেরদৌসী মজুমদার, শিমূল ইউসুফ, সারা যাকের। তাদের উত্তরপ্রজন্মের দেখা তত মেলে কই ঢাকার মঞ্চে? চট্টগ্রাম, বরিশাল, বগুড়ায় তেমন কারো কারো দেখা তবু পাই। ঢাকায় অবশ্য রোকেয়া রফিক বেবী আছেন, লাকী ইনাম, রওশন আরাও বর্তমান। ছিলেন নায়লা নুপূর, সুবর্ণা মুস্তাফা। পদাতিক-এর ‘মা’ নাটকের কাজল কতখানি যে মা হয়ে উঠেছিলেন- আজও মনে পড়ে। দর্পণে শরৎশশী-তে মিমি; বা নাগরিকের নিমা’র কতই যে সম্ভাবনা ছিলো। প্রাচী’রও ছিলো না কি? আজও তবু নিশাত, ত্রপা আছেন। ঢাকা পদাতিকের তিশা বিষাদসিন্ধু -তে কিংবা নাগরিকের প্রাক্তণী নূনা আফরোজ স্বপ্নবাজ নাটকে দীপ্যমানা হয়ে উঠেছিলেন। অল্পদিনের দল ‘কালিক’ এর মাধবী  নাটকে নামচরিত্রের অভিনেত্রী রুনা আফরোজ বা ‘নবধারা’ দলের যযাতি ও অন্য একটি নাটকের দু’একজন এমনই উজ্জ্বল আবির্ভূতা হয়েছিলেন। ডল্স হাউজ নাটকের ছন্দাও তো তেমনি একজন ছিলেন। যেমন পুতুলখেলা নাটকে কাকলী। তারা সব আজ কে কোথায়?- কই কই? কোথা গেল হাঁসগুলো তই তই তই! বাজার কিংবা সংসারকর্মে বিসর্জিতা বুঝিবা!

এই সকলের মাঝে নাজমা আনোয়ার ছিলেন একাকী, দূর অরণ্যচারিণী পথভুলে ঢাকার মঞ্চে বুঝিবা- তার উত্তরসাধিকা হবার সাধ্য আপাতত বুঝি অসম্ভব এই নগর-বাজার বিশ্বে। আমাদের কল্পনায় যে গণনাট্য-নটী-পারমিতা, তিনি যেন ছিলেন, অন্তত হতে পারতেন।- তাহলে ইতিহাস অন্তঃসত্ত্বা হয়ে উঠতো। ভাগ্যে আজও তবু তার নাম-না-জানা সহোদরা ভগিনীর দল গ্রামে গ্রামে গানে গানে অভিনয় পালায় পালায় জিয়নকাঠি বুলিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে জাগিয়ে ফেরে, ক্ষমতা-রাষ্ট্রের ফাঁদেপড়া দেশজননীর যত সন্তান-সন্ততিরে।

এমন যে নাগরিকমঞ্চে-না-ধরতে-পারা অভিনেত্রী নাজমা আনোয়ার, শিশুর মতো হাস্যমুখী সরলা অথচ ভাস্কর্যপ্রতিম নারী-সাহসিকা,- মৃত্যুকালে তারই পরিচয় হয় মিডিয়া-অভিনেত্রী বলে কেবল। মঞ্চের গো-হারা সেদিন ঢাকঢোল পিটিয়েই ঘোষিত হয়। মঞ্চ তাকে আর জায়গা দিতে পারেনি- এই তো সরল সত্য। কেবল জীবিকার জন্য কি তাকে মিডিয়ায় যেতে হয়েছে? কেউই যেখানে প্রায় কোনো শ্রদ্ধা ভালোবাসা থেকে যায় না। দায়সারা সেই ফরমায়েশী নাট্যরঙ্গে তাকে কতটুকু ‘ব্যবহার’ও করা গেছে? একটি দুটো টিভি নাট্য-ফিল্ম ছাড়া? - সেই যোগ্যতা ক’জনেরইবা ছিলো বা আছে যেখানে মঞ্চই বলতে গেলে শেষপর্যন্ত ব্যর্থই হয়েছে?

এই ট্র্যাজিক পরিণতির দায় নিশ্চয় তাঁরও। এ কথা না বললে আজও তবু, তারপরও মঞ্চ-ধরে-রাখা তাঁর সহযাত্রীদের ওপর বড়বেশি অবিচার করা হবে। তাই- ‘কার দোষ দেবে বলো/ জীবনেরই দোষ, কমবেশি সেও দায়ী’, কিংবা অমোঘ সেই কবিবচন: ‘কার দোষ ধরো তুমি/ কারে করো হেলা? এ আমার এ তোমার পাপ’।‘কারণ জেনেছি পাই যে আঘাত সেও দুঃস্থ সভ্যতাবশত’।

নাজমা আনোয়ারের পুনরাবির্ভাবের প্রতীক্ষার দায় কে নেবে বলো?- উত্তরপ্রজন্ম তোমার উপর ভার, এই তোমার সত্তার মাতৃদায়।

বিপ্লব বালা : নাট্যকার, নির্দেশক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগের শিক্ষক।